ঢাকা, ১৩ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১১ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

নারায়ণগঞ্জে ভোটের মাঠে কঠিন সমীকরণ


প্রকাশিত: ২:৪৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৩, ২০২২

সময় সংবাদ রিপোর্ট: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। ১৬ জানুয়ারি দুই হ্যাভিওয়েট প্রার্থীর জন্য অগ্নিপরীক্ষা। সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিটি করপোরেশন অন্তর্ভুক্ত এলাকায় নির্বাচনী উত্তাপও বাড়ছে। বাড়ছে প্রশাসনিক ধরপাকড়। রয়েছে ষড়যন্ত্রের শঙ্কাও। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর কর্মী-সমর্থকদের দিকে প্রশাসনিক চাপ না থাকলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটযুদ্ধে থাকবে কিনা তা নিয়ে এখনো সংশয়ে আছেন ত্যাগী নেতারা।

স্থানীয়রা বলছেন, নির্বাচনের বাকি আছে আর তিন দিন। এখনো নৌকা ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা জনসংযোগে রয়েছেন, তারাও আইভীর পক্ষে আদৌ কাজ করবেন কিনা এ নিয়ে দ্বিধা আছে।

তবে আইভীর ভোটের পাল্লা ভারি হওয়ার জন্য কিছু ভিন্ন রকম হিসাব আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, নৌকার বাইরেও আইভীর মধ্যে স্বতন্ত্র ব্যাপার আছে, যা ভিন্নমতের ভোট পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এর বাইরে বিএনপির সাবেক দুই সংসদ সদস্য ও বিএনপির সাবেক এক মেয়রপ্রার্থী আইভীর পক্ষে গোপনে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। ফলে এটি আইভীর ঝুলিতে আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে বাড়তি ভোট আনতে সহায়ক হবে- এমনটি ধারণা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে হাতি প্রতীকের প্রার্থী (স্বতন্ত্র) তৈমূর আলম খন্দকার আইভীবিমুখ আওয়ামী লীগের ভোট পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে হেফাজত ও জামায়াতসহ অনেক ইসলামি দলের ভোট যাবে তার ঝুলিতে। আর বিগত সময়ের একবার নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া, আরেকবার মনোনয়ন না পাওয়াসহ মেয়র পদে চূড়ান্ত প্রার্থী না হতে পারার সহানুভূতি পেতে পারেন তিনি। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করার কারণে তার নিজস্ব ভোট তো তৈরি হয়ে আছেই। তার নির্বাচনী কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত এক নেতা জানান,নানা সমীকরণে তৈমূর আলম খন্দকার বিজয়ী হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃঢ় বক্তব্য শেষ পর্যন্ত আইভী জনগণের রায়ে নির্বাচিত হবেন।

নাসিক নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের অবস্থান ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন  বলেন, ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী দুর্নীতি করেন না- এটি এ এলাকার মানুষ বিশ্বাস করেন। আইভী জয়ী হলে এলাকার উন্নয়ন হয় এটিও এলাকার মানুষ দেখেছে। সুতরাং আইভীর বিপক্ষে নারায়ণগঞ্জ সিটির মানুষ যাবে না। দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের বিষয়ে নাছিম বলেন, এত বড় দল আওয়ামী লীগ। এখানে মান-অভিমান থাকে। তবে ভোটের মাঠে এর প্রভাব পড়ে না। এটিই আমাদের দলের ঐতিহ্য এবং চরিত্র।

তৈমূর অনুসারীদের ধরপাকড়ের অভিযোগ ও পাড়া-মহল্লায় পুলিশি হয়রানি এবং গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, তৈমূর বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন খুব বেশি দিন আগে নয়। সুতরাং অকারণে অভিযোগ দেওয়ার নেশাটা তার এখনো কাটেনি। পূর্বের মামলায় একজনকে ধরাটা তিনি ইস্যু বানাতে চাইছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিপদগামী মানুষকে প্রশাসন গ্রেপ্তার করে। অনেক সময় লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র থানায় নিয়ে জমা রাখে। এটি প্রশাসনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। এটি নিয়ে কেন ইস্যু করা হবে? মানুষ সব বুঝে। সময়মতো জবাব দিয়ে দেবে।

যদিও তৈমূর আলম খন্দকারের চাচাতো ভাই সোহেল খন্দকার বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জের রবিকে গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে শেষ পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট ঢুকতে দেওয়া হয় কিনা। কারণ রবির হাতে নির্বাচনী এজেন্টদের সম্ভাব্য তালিকা ছিল। সেই তালিকা ধরে অন্যদেরও ধরে নেওয়া হয়েছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে ভোটার ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন। ২০১৬ সালে ভোটার ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৩১ জন। সে অনুযায়ী নতুন ভোটার ৪২ হাজার ৪৩০ জন। গত নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান হয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার। আইভী পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট, আর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খান পেয়েছিলেন ৯৬ হাজার। আগামী ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ২৭ ওয়ার্ডের ১৯২ ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে।

নির্বাচনের সমীকরণের বিষয়ে চাষাঢ়া মোড়ে জটলা পাকিয়ে কথা বলতে দেখা যায় কয়েকজনকে। তারা বলছেন, গত নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনের হিসাব ভিন্ন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার বিএনপি থেকে তৈমূর আলম খন্দকারকে বাদ দেওয়া বিএনপির কৌশলী সিদ্ধান্ত। শেষ পর্যন্ত বিএনপি সমর্থকদের প্রতি দলের নির্দেশনা থাকবে তৈমূর আলমকে ভোট দেওয়ার। কিন্তু ব্যক্তিগত কোন্দলের কারণে স্থানীয় বিএনপি নেতারা তৈমূরের বিপক্ষেও থাকতে পারেন- কেউ কেউ বলেছেন। তবে তৈমূর আলম খন্দকারের নিজস্ব ভোট, আওয়ামী লীগের অভিমানীদের ভোট এবং জামায়াত, হেফাজতের ভোট যাবে তার ঝুলিতে; ফলে তারও একটি সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। আর গত কয়দিন ধরে কর্মী-সমর্থকদের ধরপাকড়ের জবাবও দিতে পারেন ভোটাররা।

চাষাঢ়ায় স্থায়ীভাবে বাস করেন মোবাইল ফোন মেকানিক বিপ্লব মিয়া। তিনি বলেন, টানা দুবার মেয়র হওয়ায় নারায়ণগঞ্জ শহরের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন আইভী। ফলে উন্নয়নভোগীদের ভোট তিনি পেতে পারেন। তিনি নিজে নারী প্রার্থী হওয়ায় আড়াই লাখেরও বেশি নারী ভোটার থেকে দলীয় সমর্থকের বাইরে কিছু ভোট তিনি পেতে পারেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হলেও নারায়ণগঞ্জে তার স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তিনি দলের বাইরের ভোট টানতে পারেন বলে অনেকের ধারণা।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম বর্তমানে তৈমূরের পাশে নেই। তার ছেলে আবুল কাউসার আশা কাউন্সিলর পদে দাঁড়িয়েছেন। ছেলেকে নিয়ে জনসংযোগে আছেন। এ সুযোগে আইভীর জন্য ভোট চাচ্ছেন বলে জানা গেছে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিনও নেই তৈমূরের পাশে। তার ছেলে গোলাম মুহাম্মদ সাদরিলও কাউন্সিলর পদে দাঁড়িয়েছেন। ছেলের জন্য ভোট চাইতে গিয়ে তিনিও আইভীর পক্ষে কাজ করছেন বলে জানান স্থানীয়রা। একই সঙ্গে গত সিটি নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী শাখাওয়াত হোসেন খান ও তার অনুসারীদের ভোটও আইভীর দিকে যেতে পারে বলে ধারণা অনেকের। দলের অভিমানী ভোটারদের ভোট না পেলেও এই সমীকরণে জিততে পারেন আইভী।

এ বিষয়ে বিএনপির সাবেক এমপি ও সাবেক মেয়রপ্রার্থীর ভাষ্য- বিএনপির কোনো প্রার্থী নির্বাচনে নেই। তাই তারা নির্বাচন কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় আছেন। তবে অন্য কোনো প্রার্থীর পক্ষে তারা কাজ করছেন এমন খবর সঠিক নয়। সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, এ নির্বাচনে কেন্দ্র থেকে বিএনপি কোনো প্রার্থী দেয়নি। আমরা কেন থাকব। এ সরকারের অধীনে আমরা কোনো নির্বাচনে যাব না। এটি আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত। যারা যাবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন যিনি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট করছেন, দল তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। আমি তার সঙ্গে গেলে আমার বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিএনপির এ সাবেক দুই এমপির বিষয়ে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও তৈমূর আলম খন্দকারের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক এবং প্রধান এজেন্ট এটিএম কামাল হোসেন বলেন, আসলে সবাই সবার অবস্থান থেকে চিন্তা করছেন। গিয়াসউদ্দিন সাহেব আর তৈমূর খন্দকার উনারা দীর্ঘদিনের সাথী। গিয়াস উদ্দিন সাহেব এখন নিজের ছেলের জন্য ব্যস্ত। আর আবুল কালাম সাহেবও ছেলের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। উনারা ঘরে বসে থেকেই অনেক কিছু করছেন। সবার মতো উনাদের মাঠে-ময়দানে হাঁটতে হবে এমন নয়।

নির্বাচন ইস্যুতে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়। নারায়ণগঞ্জ দুই নম্বর গেট এলাকার ব্যবসায়ী রফিক উদ্দিনের ভাষ্য- তৈমূর আলম খন্দকার আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি বিএনপিরই প্রার্থী। এখানে প্রকাশ্যে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল আলী ইউসুফ খান টিটু কাজ করলেও নীরবে আছেন অনেকেই। কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা স্বার্থের কারণে আছেন নৌকার পক্ষে।

গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগে মর্গান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে সিটি নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োগকৃত প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা বলেন, নাসিক নির্বাচনের দিন প্রতিটি কেন্দ্রে স্যানিটাইজার থাকবে। আর মাস্ক ছাড়া কাউকে নির্বাচনে ডিউটি করতে দেওয়া হবে না এবং ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না। নির্বাচনে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যায় না। বিশেষ করে সকালে মহিলাদের প্রচুর ভিড় থাকে। তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন না। তার পরও যার যার জায়গা থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মাহফুজা আক্তার। তিনি জানান, মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখাসহ সাধারণ যে স্বাস্থ্যবিধি তাই মেনে চলার ব্যাপারে আমরা প্রার্থী, ভোটের ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।