করোনা মহামারীর ধাক্কায় আঘাত এনেছে জিডিপিতে প্রকাশিত: ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১ সময় সংবাদ রিপোর্ট: করোনা মহামারীর ধাক্কায় আঘাত এনেছে জিডিপিতে। করোনা ধাক্কায় মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সৃষ্টি হয়েছে ক্ষত। এ ক্ষত কাটিয়ে উঠতে সরকার করোনাকালীন প্রাণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও ধাক্কা থেকে বাঁচতে পারেনি দেশের অর্থনীতি। এদিকে জিডিপির ভিত্তি বছর পরিবর্তন করতে চার বছর ধরে চেষ্টা করে না পারলেও তিন মাস পরপর জিডিপির প্রবৃদ্ধির তথ্য দিতে চায় পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। দাতা সংস্থার কথা এখন থেকে ত্রৈমাসিক রিপোর্ট দিবে সংস্থাটি। গত বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে এ খবর জানিয়েছে বিবিএস। জিডিপির ভিত্তি বছর পরিবর্তন করতে চার বছর ধরে চেষ্টা করে না পারলেও তিন মাস পরপর জিডিপির প্রবৃদ্ধির তথ্য দিতে চায় পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। আইএমএফ’র নির্দেশিকা মানতে গিয়ে এ কাজ শুরু করেছে সরকারি সংস্থাটি। তবে কবে থেকে জিডিপির ত্রৈমাসিক তথ্য মিলবে, সেটি বলেননি সংস্থাটির কর্মকর্তারা। বিবিএসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি পরিমাপ করা হয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে। এটি পরিবর্তন করে ২০১৫-১৬ অর্থবছর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালে। কিন্তু গত চার বছরেও ভিত্তি বছর পরিবর্তন করতে পারেনি সংস্থাটি। জানতে চাইলে বিবিএসের জাতীয় মূল্য ও মজুরি শাখার পরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, জিডিপির ভিত্তি বছর পরিবর্তনের সব ধরনের কাজ শেষ। আমরা প্রস্তাবটি উপদেষ্টা কমিটিতে পাঠিয়েছি। তবে কবে নতুন ভিত্তি বছর কার্যকর হবে, সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি। জিডিপির ত্রৈমাসিক তথ্য দেওয়ার প্রসঙ্গে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক দপ্তরে ত্রৈমাসিক তথ্য সংরক্ষিত হয় না। কীভাবে তাদের কাছ থেকে ত্রৈমাসিক তথ্য মিলবে, সে জন্য সবার সঙ্গে বৈঠকে বসছি। ত্রৈমাসিক তথ্য কবে থেকে দেওয়া সম্ভব হবে, সেটি এখনো বলার সময় হয়নি বলে জানান তিনি। বিবিএসের কর্মকর্তারা জানান, জিডিপির ত্রৈমাসিক তথ্য দিতে গিয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে সংস্থাটিকে। প্রথমত, কৃষি খাতে যেসব ফসল উৎপাদিত হয়, সেগুলো কোনটি কোন মাসে যুক্ত হবে, তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। আবার সরকারের অনেক দপ্তর তাদের তথ্য বছরওয়ারি সংরক্ষণ করে থাকে। ওই সব দপ্তর কবে থেকে ত্রৈমাসিক তথ্য সংরক্ষণ করবে, না করলে বছরওয়ারি তথ্যকে কীভাবে ত্রৈমাসিকে সংযোজন করা হবে, তা নিয়েও জটিলতা তৈরি হবে। তথ্যের গরমিলের কারণে কোনো সময় জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে, আবার কোনো সময় বেড়ে যেতে পারে। যে তিন মাসে প্রবৃদ্ধি কমবে, সরকার সেটিকে প্রকাশ করতে দেবে কি না, তা নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। উদাহরণ দিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৭ সালে শ্রমশক্তি জরিপ তিন মাস পরপর দেওয়া শুরু করেছিল বিবিএস। একসময় হঠাৎ বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার বিব্রত হতে পারে, সেই আশঙ্কায় ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি প্রতিবেদন দেওয়া বন্ধ করে দেয় বিবিএস। আবার করোনাকালে এক বছরের বেশি সময় জিডিপির তথ্য প্রকাশ করেনি বিবিএস। প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে, সেটি সামনে না আনতেই সরকারের পক্ষ থেকে চাপ থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির তথ্য এক বছর পর প্রকাশ করা হয়েছে। তা ছাড়া ত্রৈমাসিক তথ্য প্রকাশ করার মতো সক্ষমতা বিবিএসের আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এসব কারণে তিন মাস পরপর জিডিপির ত্রৈমাসিক তথ্য দেওয়া কঠিন হবে। এক বছরে দেশে যেসব পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়, তার মোট বাজারমূল্যকে জিডিপি বলা হয়। এটি একটি বার্ষিক হিসাব। একটি অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে এ হিসাব করা হয়। ১০ বছর পরপর ভিত্তি বছর পরিবর্তনের নিয়ম রয়েছে। নতুন নতুন খাত যাতে হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়, তার জন্যই ভিত্তি বছর পরিবর্তন করা হয়। এদিকে মহামারীর শুরুর ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে, যা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। এক বছরের বেশি সময় ঝুলিয়ে রেখে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো গত মাসে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেছে। সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছিল, ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, যদিও পরিসংখ্যান ব্যুরো এতদিন জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, এরচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে, সে বছর ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেড়েছিল মোট দেশজ উৎপাদন। পরের ত্রিশ বছরে আর কখনও প্রবৃদ্ধি এতটা নামেনি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাবের সঙ্গে গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাবও প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যা ব্যুরো। সেখানে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, এবারের জিডিপির প্রাক্কলন তার কাছে অন্যান্য বছরের তুলনায় বাস্তবভিত্তিক মনে হয়েছে। মহামারীর ওপর কারও হাত নেই। মানুষের কাজ, অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে এটা আঘাত এনেছে। এই মহামারীর কারণে ভারতে প্রায় ১০ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশে ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি শুনে ভালো লাগছে। মহামারীর ধাক্কা সামলে দেশের অর্থনীতি এখনও যেহেতু পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তাই প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দিয়ে চলতি অর্থবছরে ‘সঠিক নীতি সহায়তা’ দিয়ে অর্থনীতিকে সঠিক পথে রাখার ওপর জোর দেন তিনি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য যখন ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীন থেকে ছড়াতে শুরু করে নতুন এক করোনাভাইরাস, অল্প সময়ের মধ্যে তা বিশ্বজুড়ে মহামারীর রূপ পায়। ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউন শুরু হয়, বন্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট, ফলে বিশ্ব বাণিজ্য এক কথায় অচল হওয়ার দশা হয়। বাংলাদেশে মহামারীর ধাক্কা শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চে। শনাক্ত রোগী বাড়তে শুরু করে বাংলাদেশও অন্যান্য দেশের পথ অনুসরণ করে, ২৬ মার্চ থেকে সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে নাগরিকদের ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। সরকারি ভাষায় ওই ‘সাধারণ ছুটি’ চলে টানা দুই মাস, এই সময় অর্থনীতির চাকা একপ্রকার অচল হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের শিল্পোৎপাদনও প্রায় বন্ধই থাকে। মহামারীর প্রথম ধাক্কায় অর্থনীতির ওই পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সাময়িক হিসাব দিলে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন অর্থনীতিবিদদের অনেকে। এখন পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, ওই অর্থবছর সরকারের ধারণার চেয়েও ১.৭৩ শতাংশ পয়েন্ট কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মহামারীর ওই সঙ্কটে অর্থনীতির চাকা যেটুকু সচল ছিল, তার মূল কৃতিত্ব কৃষিখাতের। ২০১৯-২০ অর্থবছরে (স্থির মূল্যে) কৃষিখাতে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ছিল। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে খাদ্য শষ্য, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদ আহরণে প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে। তবে মৎস্য উপখাতে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২১ শতাংশ থেকে কমে ৬ দশমিক ০২ শতাংশ হয়েছে। অনুমিতভাবেই শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধস দেখা যাচ্ছে পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত হিসাবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ১২ দশমিক ৬৭ শতাংশ ছিল। এর মধ্যে ভারী, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ থেকে কমে ১ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়েছে। শিল্পখাতের মত সেবাখাতের প্রবৃদ্ধিতেও মহামারীর ধাক্কা লেগেছে প্রবলভাবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক যে হিসাব পরিসংখ্যা ব্যুরো প্রকাশ করেছে, সেখানে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরলেও মহামারী পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্বলন করা হয়েছিল। পরিসংখ্যার ব্যুরোর প্রাক্কলনে তা আরও কমল। এই প্রাক্কলন বলছে, গত অর্থবছরে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ হবে। তবে শিল্পখাতে তা আগের বছরের ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ হবে। আর সেবাখাতের প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ হবে বলে পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাব দিয়েছে। এই প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশের মোট জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে (বর্তমান মূল্যে) ৩০ লাখ ১১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। আর মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২৪ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ২২৭ ডলারে পৌঁছেছে। বিবিএস এর হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছর জাতীয় বিনিয়োগ (বর্তমান মূল্যে) জিডিপির ২৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২ দশমিক ০৬ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশে। তবে সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১-২১ অর্বছরে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশের্। SHARES অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়: